সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৪

আমার পরিচয় কবিতা - সৈয়দ শামসুল হক

 আমার পরিচয়

- সৈয়দ শামসুল হক

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

বনলতা সেন কবিতা - জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন

 বনলতা সেন

- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন


হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

দুজন কবিতা - জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন

 দুজন

- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন


‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।

দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল-মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে- চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;

যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।
নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’
এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।
হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–

প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কবিতা - শামসুর রাহমান

 তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

- শামসুর রাহমান---সংকলিত (শামসুর রাহমান)


তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নডছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে
নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

সংকল্প কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম---সংকলিত (কাজী নজরুল ইসলাম)

 সংকল্প

- কাজী নজরুল ইসলাম---সংকলিত (কাজী নজরুল ইসলাম)


থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।।

কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে।
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি,
কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে,
কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে।

কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে।
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
সন্ধানীরা কিসের আশায়;
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।

কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি।
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি!
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।

রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম---দোলনচাঁপা

 আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে

- কাজী নজরুল ইসলাম---দোলনচাঁপা


আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;

আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!

কারার ঐ লৌহ-কপাট কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম---ভাঙ্গার গান

 কারার ঐ লৌহ-কপাট

- কাজী নজরুল ইসলাম---ভাঙ্গার গান



কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!
মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবী কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!
লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

বিদ্রোহী কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম---অগ্নিবীণা

 বিদ্রোহী

- কাজী নজরুল ইসলাম---অগ্নিবীণা

বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!

আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর -
চির-উন্নত মম শির!

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!

আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।

আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর -
চির - উন্নত মম শির!

আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!

আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!

আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।

ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ -
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না -
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

লিচু চোর কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম---ঝিঙে ফুল

 লিচু চোর

- কাজী নজরুল ইসলাম---ঝিঙে ফুল


বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,

ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।

আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল! …

সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা…!

পল্লী জননী কবিতা - জসীম উদ্‌দীন---রাখালী

 পল্লী জননী

- জসীম উদ্‌দীন---রাখালী


রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।

ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?
ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।

ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে,
ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?”
মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ”
ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?”
পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত,
পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।
নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।
ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর।
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।

বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।
চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,
দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।
যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,
বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে।
ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল,
করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল?
আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া
এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?”
মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,
ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।

“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,
রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে।
খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে,
ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”
ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,
বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,
কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে।
সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ,
হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।
এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,
ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে?

কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,
ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।
আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,
বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।
করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা;
উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।
আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।

ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,
মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর।
পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি,
কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।
ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে,
ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।
সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।
পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা,
আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।

বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪

অভিমান ---তসলিমা নাসরিন

 অভিমান

---তসলিমা নাসরিন
কাছে যতটুকু পেরেছি আসতে,
জেনো
দূরে যেতে আমি তারো চেয়ে বেশী পারি।
ভালোবাসা আমি যতটা নিয়েছি লুফে
তারো চেয়ে পারি গোগ্রাসে নিতে ভালোবাসা হীনতাও।
জন্মের দায়, প্রতিভার পাপ নিয়ে
নিত্য নিয়ত পাথর সরিয়ে হাঁটি।
অতল নিষেধে ডুবতে ডুবতে ভাসি,
আমার কে আছে একা আমি ছাড়া আর ?

আকাশলীনা জীবনানন্দ দাশ

 আকাশলীনা

জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।

সে জীবনানন্দ দাশ

 সে

জীবনানন্দ দাশ

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;

সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’
‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’

মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।

সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে

মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক – তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।

আকাশ সিরিজ নির্মলেন্দু শুণ

 আকাশ সিরিজ

নির্মলেন্দু শুণ

শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন

শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
অহংকারের মুছে যাবে সকল দীনতা।

শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
স্পর্শ সুখে লেখা হবে অজস্র কবিতা।

শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।

শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।

শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
তারপর হবো ইতিহাস।

যাত্রাভঙ্গ নির্মলেন্দু গুণ

 যাত্রাভঙ্গ

নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন কর যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।

তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে।

নায়ের মাঝে বসবো বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।

তুই কেমন করে যাবি

উত্তর শামসুর রাহমান

 উত্তর

শামসুর রাহমান

তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে
বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’

কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব
নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।
জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,

তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোত্স্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।

মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।

চিঠি দিও মহাদেব সাহা

 চিঠি দিও

মহাদেব সাহা

করুণা করেও হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখি প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড় বোনা একখানি চিঠি
চুলের মতন কোন চিহ্ন দিও বিষ্ময় বোঝাতে যদি চাও।
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল পাখি, সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দাও।

আজোতো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌছে দেবে।
এক কোনে শীতের শিশির দিও এক ফোঁটা,
সেন্টের শিশির চেয়ে তৃণমূল থেকে তোলা ঘ্রাণ

এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!
ওইতো রাজার লোক যায় ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে,
কাঁধে ব্যাগ,
হাতে কাগজের একগুচ্ছ সীজন ফ্লাওয়ার

কারো কৃষ্ণচূড়া, কারো উদাসীন উইলোর ঝোঁপ,
কারো নিবিড় বকুল

এর কিছুই আমার নয়
আমি অকারণ হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি,
আমার কি কোনো কিছু নেই?

করুনা করেও হলে চিঠি দিও,
ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে

কিছুই লেখার নেই তুব লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে

সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে,
তাই লিখো

করুণা করেও হলে চিঠি দিও,
মিথ্যা করেও হলে বলো, ভালোবাসি।

রান্নাঘরে নারীবাদী হুমায়ুন আজাদ

 রান্নাঘরে নারীবাদী

হুমায়ুন আজাদ

তুমি এসেছিলে লিসবন আর আমি দূর ঢাকা থেকে;
দেখা হয়েছিলো গ্রান্টস হাউজের উষ্ণ রান্নাঘরে;

রাঁধছিলে তুমি পোর্ক ও পোটটো; আমার শুঁটকি রান্না দেখে
চেয়ে রয়েছিলে দুই নীল চোখ বিষ্ময়ে পুরো ভ’রে।

‘হাই’, হেসে বলেছিলে,’কোথা থেকে যেনো তুমি?’
‘বাঙলাদেশ; আর ‘তুমি?’-বলেছিলে, ‘আমি পর্তুগাল।’
‘বাঙলাদেশ?’ চিনতে পারো নি;-সাগর না মরুভূমি;
লজ্জা তোমার গন্ডদেশকে ক’রে তুলেছিলো আরো লাল।

তারপর আমরা অনেক রেঁধেছি; বুঝেছি রান্নায়ও আছে সুখ।
তুমি খুব সুখে খেয়েছো শুঁটকি, ভর্তা, বিরিয়ানি, মাছ, ভাত,
আমিও খেয়েছি পোর্ক ও পোটেটো; স্বাদে ভ’রে গেছে মুখ;
কথা ব’লে ব’লে বুঝতে পারি নি গভীর হয়েছে রাত।

”নারীবাদী আমি’, বলেছিলে. ‘খুবই ঘৃণা করি প্রেম আর বিয়ে,
প্রেম বাজে কথা; বিয়ে? ওহ গশ! খুবই নোংরা কাজ।’
‘প্রেম বেশ লাগে’, বলেছি আস্তে, ‘কখনো বিবাহ নিয়ে
ভাবি নি যদিও; মনে হয় বিবাহের কোনো দরকার নেই আজ।’

চুমো খেতে খেতে ঘুমিয়েছি আমরা; বহু রাত গেছে সুখে,
আমাদের দেহে বেজেছে অর্গ্যান, ব্যাগপাইপ রাশিরাশি;

একরাতে দেখি কী যেনো জমেছে তোমার সুনীল চোখে,
আধোঘুমে ব’লে উঠেছিলে, ‘প্রিয়, তোমাকে যে ভালোবাসি।’
কেঁপে উঠেছিলো বুক সেই রাতে; বেশি নয়, আট মাস পরে
বলেছিলে, ‘চলো বিয়ে করি, আমার এখন বিয়ের ইচ্ছে ভারি।’

চুমো থেকে আমি পিছলে পড়েছি, ফিরেছি নিজের ঘরে;
‘চলো বিয়ে করি, চলো বিয়ে করি’, প্রতিটি চুমোর পরে;
এভাবেই , প্রিয়, একদিন হলো আমাদের চিরকাল ছাড়াছাড়ি।

নিঃসঙ্গতা আবুল হাসান

 নিঃসঙ্গতা

আবুল হাসান

অতোটুকু চায় নি বালিকা!
অতো শোভা, অতো স্বাধীনতা!
চেয়েছিলো আরো কিছু কম,

আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতোটুকু চায় নি বালিকা!

অতো হৈ রৈ লোক, অতো ভিড়, অতো সমাগম!
চেয়েছিলো আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি,

চেয়েছিলো
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী

অনেক ছিল বলার কাজী নজরুল ইসলাম

 অনেক ছিল বলার

কাজী নজরুল ইসলাম

অনেক ছিল বলার, যদি সেদিন ভালোবাসতে।
পথ ছিল গো চলার, যদি দু’দিন আগে আসতে।

আজকে মহাসাগর-স্রোতে
চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা সেই আঁধারে ভাসতে।
গহন রাতি ডাকে আমায় এলে তুমি আজকে।
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে।

আসতে যদি হে অতিথি
ছিল যখন শুকা তিথি
ফুটত চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।

অনন্ত প্রেম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 অনন্ত প্রেম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার-

কত রূপ ধ’রে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,

প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতিপুরাতন বিরহমিলন-কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে

কালের তিমির রজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রবতারকার বেশে।

আমরা দু’জনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে।

আমরা দু’জনে করিয়া খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে

বিরহবিধূর নয়নসলিলে
মিলনমধুর লাজে।
পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে।

আজি সেই চিরদিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।

নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিলপ্রাণের প্রীতি
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে-
সকল প্রেমের স্মৃতি,
সকল কালের সকল কবির গীতি।

প্রেমের কবিতা || অসম্ভব সুন্দর প্রেমের কবিতা || বিখ্যাত প্রেমের কবিতা || গভীর প্রেমের কবিতা আবেগি প্রেমের কবিতা প্রেমের কবিতা ক্যাপশন তীব্র প্রেমের কবিতা আধুনিক প্রেমের কবিতা পৃথিবীর সেরা প্রেমের কবিতা

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা – শহীদ কাদরী



 ভয় নেই

আমি এমন
ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক
রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।
ভয় নেই…আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের
সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর
সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক,
প্রিয়তমা!
সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ
হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক
হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয়
পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু
নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।
ভয় নেই আমি এমন
ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি,
প্রিয়তমা।
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন
আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-
বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ
কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার
লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-
ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।

মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতা

 






তোমার চোখ এতো লাল কেন ?



আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,

শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য।

বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাত পাখা নিয়ে

কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না।

আমি জানি এই ইলেকট্রিকের যুগ

নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।

আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুকঃ

আমার জল লাগবে কিনা, আমার নুন লাগবে কিনা,

পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরোও একটা

তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কিনা।

এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ একজন ভেতর থেকে আমার ঘরের দরোজা

খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।

কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে

জিজ্ঞেস করুকঃ “তোমার চোখ এতো লাল কেন







তুলনামূলক হাত



তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷

তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই

খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;

আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর

চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে,

তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷



তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে

খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার,

সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷



তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন

তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷

আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো

তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই,

ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷



তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে

আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি

তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো

আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই

হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷





মানুষ



আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,

হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,

মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।



আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,

গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,

অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।

কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,

সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে

সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।



আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,

বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,

রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,

পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।



আমি হয়তো মানুষ নই,

মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?

মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,

নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,

নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে

ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।



মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,

বাবা থাকতো, বোন থাকতো,

ভালোবাসার লোক থাকতো,

হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।



আমি হয়তো মানুষ নই,

মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা

আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত

বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।



মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;

অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,

অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।







যাত্রাভঙ্গ



হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে

মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না

এক কে করি দুই।



হেমের মাঝে শুই না যবে,

প্রেমের মাঝে শুই

তুই কেমন কর যাবি?

পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া

আমাকেই তুই পাবি।



তবুও তুই বলিস যদি যাই,

দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।



তখন আমি একটু ছোঁব

হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর

বিদায় দুটি পায়ে,

তুই উঠবি আমার নায়ে,

আমার বৈতরণী নায়ে।



নায়ের মাঝে বসবো বটে,

না-এর মাঝে শোবো,

হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ

দুঃখ দিয়ে ছোঁব।









শুধু তোমার জন্য



কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে

গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।

তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও

কতবার যে আমি সে কথা বলিনি

সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য

দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম

আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ

‘এই ওঠো,

আমি, আ…মি…।‘

আর অমি এ-কী শুনলাম

এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে

কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে

কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,

আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,

আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।

তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,

আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।









পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু



একদি চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো

মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;

একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,

একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।



একদি চুল কাটতে যাব না সেলুনে

একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।

একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,

কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।



একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,

ট্রেনের টিকিট কেটে

একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।

একদিন পরাজিত হবো।



একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি

কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।

একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে

পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।















মোনালিসা





চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই

সদ্য-রজঃস্বলা এক কিশোরীরে−

যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন

তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা

ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে।



মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে

চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে−

দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব।

মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে

নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ।

মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়−

‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন?

মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’



মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলেন,

‘বোকা মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না,−আয়,

আজ আমি কুসুমগরমজলে

তোকে নিজ হাতে গোসল করাব।’

মা’র বুকে মাথা পেতে মেয়েটি তখন

নিজেই কখন যেন মা হয়ে যায়।



এই লাভাস্রোত, এই সঙ্গকাতরতা

তাকে শেষে কোথায় ভাসিয়ে নেবে

জানে না সে; বোঝে না সে

তার বৃক্ষপত্রে কার হাওয়া লাগে?

অগ্নিকুন্ডে বায়ুর মতন ছুটে এসে

কে তাকে জড়াবে আদরে, সোহাগে?



জানে না সে, বোঝে না সে তার চোখে,

ঠোঁটে, তলপেটে, ঘুমভাঙা স্তনে

জেগেছে যে ঢেউ তার গন্তব্য কোথায়?

আনন্দ পুরুষে? নাকি আনন্দ সন্তানে?



এইসব দেহতত্ত্ব জানার আগেই,

এইসব গূঢ় গোপন রহস্যভেদ

হওয়ার আগেই

আষাঢ়ের এক বৃষ্টিভেজা রাতে

মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেল−

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সাথে।



লিওনার্দো অতঃপর দীর্ঘ রাত্রি জেগে

জীবনের শেষ রং দিয়ে

তাঁর প্রিয়তমা তরুণী ভার্যা

মোনালিসাকে ক্যানভাসে আঁকলেন।



শিল্পের ঔরসে মোনালিসা গর্ভবতী হলে

স্বর্গ থেকে মখলুকাতে পুষ্পবৃষ্টি হলো।

সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে−

শান্ত হলো ক্ষিপ্তোন্মত্ত সমুদ্রের জল।



মোনালিসা, য়ুরোপের প্রথম রমণী−

পুরুষের কান্ড দেখে হাসে।









ফুলদানি





যেকোনো বাগান থেকে যেটা ইচ্ছে সেই ফুল,

যেকোনো সময় আমি তুলে নিয়ে যদি কভু

তোমার খোঁপায়, আহা, অজগর তোমার খোঁপায়

সাজাবার সুজোগ পেতাম–; তাহলে দেখতে লীলা,

তোমার শরীর ছুঁয়ে লাবণ্যের লোভন ফুলেরা

উদ্বেল হৃদয়ে নিত্য বিপর্যস্ত হতো, মত্ত মমতায়

বলতো আশ্চর্য হয়ে, হতো বলতেইঃ

‘খোঁপার মতন কোনো ফুলদানি নেই৷’









টেলিফোনে প্রস্তাব





আমি জানি, আমাদের কথার ভিতরে এমন কিছুই নেই,

অনর্থ করলেও যার সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আমাদের

দুর্বলতা প্রমাণ করা সম্ভব। আমিও তো তোমার মতোই

অসম্পর্কিত-জ্ঞানে এতদিন উপস্থাপন করেছি আমাকে।

তুমি যখন টেলিফোন হয়ে প্রবেশ করেছো আমার কর্ণে-

আমার অপেক্ষাকাতর হৃৎপিণ্ডের সামান্য কম্পনও আমি

তোমাকে বুঝতে দিই নি। দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় পাছে।



তুমিও নিষ্ঠুর কম নও, তুমি বুঝতে দাওনা কিছু। জানি,

আমার কাছেই তুমি শিখেছিলে এই লুকোচুরি করা খেলা।

কিন্তু এখন, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমাদের বেলা,

তখন ভেতরের চঞ্চলতাকে আমরা আর কতটা লুকাবো?

অস্ত যাবার আগে প্রবল সূর্যও চুম্বন করে পর্বত শিখর,

আর আমরা তো দুর্বল মানুষ, মিলনে বিশ্বাসী নর-নারী।

কার ভয়ে, কী প্রয়োজনে আমরা তাহলে শামুকের মতো

স্পর্শমাত্র ভিতরে লুকাই আমাদের পল্লবিত বাসনার শূঁড়।



তার চেয়ে চল এক কাজ করি, তুমি কান পেতে শোনো,

তুমি শুধু শোনো, আর আমি শুধু বলি, বলি, ভালবাসি।









ওটা কিছু নয়





এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।

এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,

-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর

মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।



সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,

ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;

রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,

নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে

হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।



অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;

অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।









এবারই প্রথম তুমি





ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে

মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না

ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে

ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না।

ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না

নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি এখানে ছিলে না

এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না

এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না

নীল নবঘন গগনে ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।









এপিটাফ





করতল ভরা এই ম্লান রেখাগুলো তোমাদের জন্য

রেখে গেলাম। হাড়গুলো থেকে সার হবে,

সার থেকে জন্ম নেবে হাড়ের গোলাপ।

আমার যে ছেলেটির জম্ন হয় নি, তাকে দিও

এই দুর্বিনিত শীসের কলম।



যে শব্ দটি আমি উচ্চারণ করতে পারলুম না—

তোমাদের প্রচণ্ড ঘৃণায়, সন্দেহে, তার আত্মা

রক্তাপ্লুত হয়েছে বারবার।

যে গান গাইতে পারি নি, তার সুর বেজেছে চৈতন্যে।

যে কবিতা লেখা হল না সে-ও ছিল

সংগঠিত সীসার ভিতরে।



এই কবরগুলো সাক্ষ দেবে, ভালবেসেছিলাম।









উল্টোরথ





শুধু চোখে নয়, হাত দিয়ে হাত,

মুখ দিয়ে মুখ, বুক দিয়ে বুক ;

ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট খোলো, এইভাবে

খুলে খুলে তোমাকে দেখাও ।

শুধু চোখে নয়, নখ দিয়ে নখ,

চুল দিয়ে চুল, আঙুলে আঙুল;

হাঁটু দিয়ে হাঁটু, উরু দিয়ে উরু,

আর এটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাও ।



শুধু চোখে নয়, চোখে চোখে চোখ,

বাহু দিয়ে বাহু, নাভি দিয়ে নাভি;

চাবি দিয়ে তালা খোলা দেখিয়াছি,

তালা দিয়ে খোলো দেখি চাবি ?











উপেক্ষা





অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷

তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি

সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও

ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷



আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?











আসমানী প্রেম





নেই তবু যা আছের মতো দেখায়

আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি,

সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায়

তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি !



জেনেও ভালোবেসেছিলাম তারে ,

ধৈর্য ধরে বিরহ ভার স’বো ;

দিনের আলোয় দেখাবো নিষ্প্রভ

জ্বলবো বলে রাতের অন্ধকারে ।



আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে

মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ?

আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে

গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে !



মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে

বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে !

মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে ,

ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে !











আমি চলে যাচ্ছি





জয় করবার মতো একটি মনও যখন আর অবশিষ্ট নেই,

তখন আমার আর বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি যাই।

তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায়

মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি যাই।

মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন আমি যাই,

ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি।



যদি কোনোদিন এই রাত্রি ভোর হয়, যদি কখনো আবার

সূর্য ওঠে রূপসী বাংলায়, আবার কখনো যদি ফিরে পাই

আমার যৌবন, যদি পাই অনন্ত স্বপ্নের মতো নারী, কবি

না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি।



অভিভূত কবির মতন নারীকে আমি ভালোবেসেছিলাম।

সুচিত্রা সেনের মতো অপরূপা, বিদুষী-সুন্দরী ছিল তারা,

তাদের দেহে স্বর্গের লাবণ্য ছিল কিন্তু হৃদয় ছিল ঘাস।

আমার প্রেম নিয়ে তারা কত রকমের যে রহস্য করেছে-

গাধা ভেবে কেউবা নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দিয়েছে মুলো;

কেউবা উরাত দেখিয়ে-দেখিয়ে কাটিয়েছে কাল। তারপর

একদিন সর্পচর্মবৎ আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে

দূরে। আমি নিঃস্ব গৃহকোণে, তারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে।

অথচ তাদের কথা ভেবে আমি কেঁদেছি নিদ্রায়-জাগরণে।

এখন আমারও হৃদয়ে আর প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই,

বাসনার আলোড়ন নেই, আজ আমারও হৃদয়ে শুধু ঘাস,

শুধু স্মৃতি, শুধু স্মৃতি, শুধু স্মৃতি আর স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস।



জয় করবার মতো একটি মনও যখন আর অবশিষ্ট নেই,

তখন আর আমার বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি আর

কতো ভালোবাসবো? আর কার জন্যে অপেক্ষা আমার?

তার চেয়ে এই কি যথার্থ নয়? আমি খুব দূরে চলে যাই।



যদি কোনোদিন এই রাত্রি ভোর হয়, আবার কখনো যদি

সূর্য ওঠে নিষ্ঠুর বাংলায়, আবার কখনও যদি ফিরে পাই

আমার যৌবন, যদি পাই আমার স্বপ্নের সেই নারী, কবি

না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি।



তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায়

মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি চলি।

মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন, আমি যাই,

ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি।







আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও





তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।



এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা।

ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব,

শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে।

আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব,

তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়।

আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।



পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে,

চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে।

আমার কিসের ভয় ?



কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর,

শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ,

আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে

জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে।

আমার কিসের ভয় ?



তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও

এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর,

ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে।

আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি;

আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখ আগ্নেয়াস্ত্র,

কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ,

উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা।



আমার কিসের ভয় ?

তোমার পায়ের নিচে আমিও কবর হব,

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।











আগ্নেয়াস্ত্র





পুলিশ স্টেশনে ভিড়,আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের

সন্দিগ্ধ সৈনিক।সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের

শটগান,রাইফেল,পিস্তল এবং কার্তুজ,যেন দরগার

স্বীকৃত মানত,টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত।



আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি

কোমল বিদ্রোহী,প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে

অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্তক

একটি আগ্নেয়াস্ত্র,আমি জমা দেইনি।









আকাশ ও মানুষ





কবে থেকে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে একা,

তার বুক থেকে খসে পড়েছে কত তারা।

বেঁচে থাকলে আরো কত তারাই খসবে,

তা নিয়ে আকাশ কি দুঃখ করতে বসবে?



না, বসবে না, আমি বলছি, লিখে নাও,

আকাশকে তো মহান মানি এ-কারণেই।

মনুষ্যবৎ হলে কি মানুষ তাকে মানতো?



প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়,

আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়।

তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও,

হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও।











পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক



পাঁজরে প্রবিষ্ট প্রেম জেগে ওঠে পরাজিত মুখে,

পতিগৃহে যেরকম পুরোনো প্রেমিক

স্বামী ও সংসারে মুখোমুখি ।

প্রত্যাখ্যানে কষ্ট পাই,–ভাবি, মিথ্যে হোক

সত্যে নাই পাওয়া । বুকের কার্নিশে এসে

মাঝে-মধ্যে বসো প্রিয়তমা,

এখানে আনন্দ পাবে, পাবে খোলা হাওয়া ।



সেই কবে তোমাকে বুনেছি শুক্রে, শুভ্র বীজে,

যখন নদীর পাড় ঢাকা ছিল গভীর সবুজে ।

সময় খেয়েছে মূলে, বীজের অঙ্কুরে অমাক্রোধ,

দাবাগ্নিতে পুড়ে গেছে ভালোবাসা জনিত প্রবোধ ।



অহল্যাও পেয়েছিল প্রাণ জীবকোষে, পাথর-প্রপাতে

একদিন । তোমার অতনু জুড়ে কোনোদিন হবে নাকি

সেরকম প্রাণের সঞ্চার ? কোনদিন জাগিবে না আর?

পুরোনো প্রেমিক আমি কতো পুরাতনে যাবো?

ক্ষমা করো ভালোবাসা, প্রিয় অপরাধ ।



যদি কভু মধ্যরাতে পরবাসে ঘুম ভেঙে যায়,

যদি আচ্ছন্ন স্বপ্নের ঘোরে উচ্চারণ করো এই মুখ,

যদি ডাকো যৌবনের প্রিয় নাম ধরে–;

রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাবো পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক ।

মুখোমুখি দাঁড়াবো তোমার, যদি ক্ষমা পাই ।









গতকাল একদিন



গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল

আমাদের চারিধারে,

দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম

জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি

শিখার ভিতরে মুখ ।

গতকাল ছিল জীবনের কিছু

মরণের মতো সুখ ।



গতকাল বড়ো যৌবন ছিল

শরীরে শরীর ঢালা,

ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল

উদাসীন গাছপালা ।



আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে

লুকিয়েছিলাম প্রেম,

গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল

বুঝিনি কী হারালাম !



গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে

বাতাস তুলেছে গ্রিবা,

চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার

উজ্জ্বল মধুরিমা ।



গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল

সারাজীবনের চাওয়া,

চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে

চোখের বাহিরে যাওয়া ।











এক ধরনের এপিটাফ



বায়ুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;

জানি, একদিন বায়ুতেই যাবো মিশে ।

আমাকে তখন যদি দরকার হয় কারও,

আজকের মতো সহজে পাবে না খুঁজে ।

চৈত্রের ঝড় হয়ে লুটিয়ে পড়বো আমি

বৃক্ষপত্রে, ধু-ধু মাঠে, –মঠের গম্বুজে ।



বায়ুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;

জানি, একদিন বায়ুতেই যাবো মিশে ।

তখন আমাকে যদি খোঁজ, যদি খোঁজ,

শুভ্র অভ্রবিন্দুবৎ তখন আমাকে পাবে

কম্পমান পদ্মের পাতায়, ঘাস-শীষে ।

মধুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;

মৃত্যু হয়ে একদিন মিশে যাবো বিষে ।







এবারই প্রথম তুমি



ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে

মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না

ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে

ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না।

ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না

নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি এখানে ছিলে না

এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না

এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না

নীল নবঘন গগনে ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।











সেই প্রজাপতি



ফুলের মতো দেয়ালটাতে

একটি প্রজাপতি,

দঃসাহসে বসলো এসে

আলোর মুখোমুখি;

চিত্রিত নয় কালো রঙের

পাখনা দু’টি মেলে ।

এবার বুঝি এলে ?



দেয়াল জুড়ে লাগল তার

ঘরে ফেরার কাঁপন,

প্রাণের মাছে ফিরল বুঝি

চিরকালের আপন ।



ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়ে

মৃত্যুখানি কেনা,

শেষ করেছি প্রথম দিনে

হয়নি শুধু চেনা!



চোখের পাশে দেয়ালটিতে

বসলে তুমি যেই,

হঠাৎ-চেনা পাখার রেণু

আঙ্গুল ভরে নেই ।



এমন করে পরের ঘরে

দেয়ালে কেউ বসে?

হঠাৎ যদি ভালোবাসার

পলেস্তার খসে?



আলিঙ্গনে বন্দী করে

প্রতীক বাহুপাশে,

হঠাৎ যদি এই আমাকে

অন্যে ভালোবাসে?



রুপান্তরে পুড়িবে তোর

ক্লান্ত দু’টি ডানা,

চিত্রিত নয় কালো রঙের

পৃথিবী একটানা ।



আমি কেবল আমি কেবল

আমি কেবল দেখি,

ভালোবাসার দেয়াল জুড়ে

একটি প্রজাপতি ।





আমার বসন্ত



এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে,

মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর,

পাতা ঝরা, স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা চাঁদ, জ্যোৎস্নাময়

রাতের উল্লাসে কালো বিষ । এ না হলে বসন্ত কিসের ?



গাছের জরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়েছে অপিচ্ছিল বোধ,

ওর মুখে কুমারীর খুন, প্রসূতির প্রসন্ন প্রসূন ।

কন্ঠ ভরে করি পান পরিপূর্ণ সে-পাত্র বিষের,

চাই পূর্ণ শিশিরে নির্ঘুম । এ না হলে বসন্ত কিসের?





আকাশ সিরিজ



শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,

ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন।



শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,

অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা।



শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,

স্পর্শসুখে লিখা হবে অজস্র কবিতা।



শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,

শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।



শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,

অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।



শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,

তারপর হব ইতিহাস।









স্ববিরোধী



আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ন বর্ষায়,

কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত ।



আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে,

কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।



আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে,

কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি ।



আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে,

ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা ।



জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম,

এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায় ।



আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম,

এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।





স্ত্রী



রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে,

বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়সে ঢুকে যাও-

সে যেখানে নগ্ন দেহে স্নানার্থেই তৈরি হয়ে আছে

আলোকিত দুপুরের কাছে, মনে রেখো, তোমার রাত্রি নেই

অন্ধকার বলে কিছু; বিবাহিত মানুষের কিছু নেই

একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রী-শয্যা ছাড়া। তাতেই শয়ন কর

বাথরুমে, পুজোঘরে, পার্কে, হোটেলে,

সন্তানের পাশ থেকে টেনে এনে ঠোটগুচ্ছে চুমু খাও তাকে।



তার প্রতিটি উৎফুল্ল লগ্নে এক-একটি চুম্বন,

প্রতিটি রক্তিম মুখে এক-একটি নিঃশ্বাস দিতে হবে।

সভ্যতা ধংস হোক, গুরুজন দাড়াক দুয়ারে,

শিশুরা কাদতে থাক, যমদূত ফিরে যাবে এবং অভাব

দেখো লজ্জা পেয় ম্লান হবে কিশোরীর মতো।



যেমন প্রত্যহ মানুষ ঘরের দরোজা খুলেই

দেখ নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তেমনি প্রত্যহ

শাড়ির দরোজা খুলে স্ত্রীকেও উলঙ্গ করে

দেখে নিতে হয়, ভালো করে দেখে নিতে হয়:

-জঙ্ঘায়, নিতম্বে কিংবা সংরক্ষিত যোনির ভিতরে

অপরের কামনার কোন কিছু চিহ্ন আছে কি না।





আক্রোশ



আকাশের তারা ছিঁড়ে ফেলি আক্রোশে,

বিরহের মুখে স্বপ্নকে করি জয়ী;

পরশমথিত ফেলে আসা দিনগুলি

ভুলে গেলে এতো দ্রুতো,হে ছলনাময়ী?



পোড়াতে পোড়াতে চৌচির চিতা নদী

চন্দনবনে আগ্নির মতো জ্বলে,

ভূকম্পনের শিখরে তোমার মুখ

হঠাৎ স্মৃতির পরশনে গেছে গলে ।



ফিরে গেলে তবু প্রেমাহত পাখি একা,

ঝড় কি ছিলো না সেই বিদায়ের রাতে >

ভুলে গেলে এতো দ্রুত, হে ছলনাময়ী,

পেয়েছিলে তাকে অনেক রাত্রিপাতে ।



শব্দের চোখে করাঘাত করি ক্রোধে,

জাগাই দিনের ধূসর প্রতিচ্ছবি ।

না-পাওয়া মুখের মুখর সুষমা দিয়ে,

তবুও তোমার ছলনা-আহত কবি

তোমাকেই লেখে, তোমাকেই রচে প্রিয় !





মাছি



একটি মাছি বুকের ‘পরে

একটি মাছি নাকে,

একটি মাছি আমাকে চেনে

একটি চেনে তাকে।



আমাকে চেনে,তাকেও চেনে

সেই মাছিটি কই?

নাকেও নেই, বুকেও নেই

চোখের জলে ঐ।











অগ্নিতে যার আপত্তি নেই





থামাও কেন? গড়াতে দাও,

গড়াক;

জড়াতে চায়? জড়াতে দাও,

জড়াক ।



যদি পাকিয়ে ওঠে জট,

তৈরি হবে নতুন সংকট

সুখ না হলে দুঃখ দিয়ে

পূর্ণ হবে ঘট ।



ডরাও কেন? এগোতে দাও

জাগুক;

সরাও কেন? আগুনে হাত

লাগুক ।



জীবন শেষে মরণ হয়,

মরণ শেষে হয় কী?

আগ্নিতে যার আপত্তি নেই

মাটিতে তার ভয় কী?





আকাশ



আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,

আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার

আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ

যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,

তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে

স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়

একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ…”আকাশ” ।



আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি ।

জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু

এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে ।

জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?

আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি

উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে

আর কোন কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না ।

যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো

আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল

এই যন্ত্রণাক্ত আমাশ শব্দটি ।



তোমার আমার মাঝে আছে এরকম

বক্ষফাটা অনেক আকাশ । – আমি

ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে

কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে ।





কন্টক বাসর



না হয় রক্ত হবে

মাধবীর সিঁথির সিঁদুর

তবুও সত্যের মত রোগী হয়ে

সচকিত স্বপ্নের রুটি

শুকরের মত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব



না হয় দুর্গম হলো

কন্টকীত ভোরের নীলিমা

তবুও মদাক্রান্ত পশুর মত

দুর্গম বালির ঝড়

মরুভূর উট হয়ে হেঁটে হেঁটে যাব।

এবং যাবই আমি

রক্তের খর নদী বেয়ে

আকাঙ্কিত মাধবীর প্রশুদ্ধ বাসরে

যখন ভ্রষ্টা নারী

মতান্তরে কাম্য হয়

সূর্ষরঙ কোন এক ভোরের আসরে।







আমার সংসার



সংসার মানে সোনার কাঁকনে জীবনের রঙ লাগা,

সংসার মানে রক্তে-মাংসে সারারাত্তির জাগা।



সংসার মানে অপেক্ষমাণ একজোড়া চোখে দাবি,

সংসার মানে সাজানো ভুবন, আঁচলের খোঁটে চাবি।



সংসার মানে অনাগত শিশু, পুতুলে সাজানো ঘর,

সংসার মানে মনোহর নেশা, ঈশানে-বিষাণে ঝড়।



সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা, বেদনার জলাভূমি,

সংসার মানে সংসার ভাঙা, সংসার মানে তুমি।







ওটা কিছু নয়



এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।

এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,

-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর

মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।



সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,

ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;

রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,

নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে

হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।



অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;

অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।





গতকাল একদিন







গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল

আমাদের চারিধারে,

দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম

জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি

শিখার ভিতরে মুখ ।

গতকাল ছিল জীবনের কিছু

মরণের মতো সুখ ।



গতকাল বড়ো যৌবন ছিল

শরীরে শরীর ঢালা,

ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল

উদাসীন গাছপালা ।



আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে

লুকিয়েছিলাম প্রেম,

গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল

বুঝিনি কী হারালাম !



গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে

বাতাস তুলেছে গ্রিবা,

চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার

উজ্জ্বল মধুরিমা ।



গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল

সারাজীবনের চাওয়া,

চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে

চোখের বাহিরে যাওয়া ।





দু’জনের ভাত







গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে

মনে কি পড়ে না? পড়ে ।

ভালো কি বাসি না? বাসি ।

শ্লথ টেপ থেকে সারা দিন জল ঝরে,

সেই বেনোজলে এঁটো মুখ ধুয়ে আসি ।



গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে

প্রেম কি জাগে না? জাগে ।

কিছু কি বলি না? বলি ।

তিতাস শিখায় যতটুকু তাপ লাগে,

অনুতাপে আমি তার চেয়ে বেশি গলি ।



গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে

আমি কি কাঁদি না? কাঁদি ।

কাঁচা কাকরুল ভাজার কবিতা লেখি,

বড়-ডেকচিতে দু’জনের ভাত রাঁধি ।



গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে-খেতে

কিছু কি ভাবি না? ভাবি ।

ভেবে কি পাই না? পাই ।

তবু কি ফুরায় তুমি-তৃষ্ণার দাবী?

ভাত বলে দেয়, তুমি নাই, তুমি নাই ।







আশাগুলি







জ্যা-মুক্ত হয়নি চিত্ত

অধীর মিলনে কোনোদিন ।

পরশে খুলেছে দ্বার, বারবার

কেটেছে অস্থির ঘুমে

শূন্য চিরশয্যা তুমি-হীন ।



অপক্ব মৈথুনে বিবসনা

শ্লীলতা ভাঙেনি শব্দ,

আমাদের অবিমৃষ্য যুগলযৌবন

অথচ জেগেছে কামে

সুপ্তোত্থিতে, প্রিয়তমে

মুখর মৃণালে, প্রিয় নামে ।



তোমাকে বেসেছি ভালো

তীব্রতম বেদনার লাগি ।

মৃত্যুর শিয়রে বসি

সেই প্রিয় মুখে রাত্রি জাগি

একদিন উচ্চরিত প্রার্থনার ভাষা;

করেছিনু আশা, আজ পূর্ণ হবে ।









খেলাঘর



শিশুরা খেলাঘর করে ।

তারা হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন নিয়ে

বড়দের মতো সংসার সংসার খেলে ।

তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে

ঘুমভাঙ্গার পর শুরু হয় তাদের অন্যখেলা ।

এক্কা-দোক্কা, গোল্লাছুট কিংবা

কানামাছি ভোঁ ভোঁ !



বড়োরাও খেলাঘর করে ।

তাদের বাসন-কোসনগুলো আকৃতিতে বড়ো,

তাদের কামনা বাসনার মতো ।

তারা তাদের খেলাঘরের নাম রাখে সংসার ।

শিশুদের মতো তারাও ক্লান্ত হয় ,

তারাও সংসার ভাঙ্গে, কিন্তু শিশুদের মতো

তারা ঘুমুতে পারে না ।







বিষ্টি



আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা

বাতাস জুড়ে বিষ্টি,

গাছের পাতা কাঁপছে আহা

দেখতে কী যে মিষ্টি!



কলাপাতায় বিষ্টি বাজে

ঝুমুর নাচে নর্তকী,

বিষ্টি ছাড়া গাছের পাতা

এমন করে নড়তো কি?



চিলেকোঠায় ভেজা শালিখ

আপন মনে সাজ করে,

চঞ্চু দিয়ে গায়ের ভেজা

পালকগুলি ভাঁজ করে।



হাঁসেরা সব সদলবলে

উদাস করা দিষ্টিতে

উঠানটাকে পুকুর ভেবে

সাঁতার কাটে বিষ্টিতে।



আকাশ এতো কাঁদছে কেন

কেউ কি তাকে গাল দিলো?

ছিঁচকাঁদুনে মেঘের সাথে

গাছগুলি কি তাল দিলো?



সকাল গেল, দুপুর গেল-

বিকেল হ’য়ে এলো কী?

আচ্ছা মাগো তুমিই বলো

মেঘেরা আজ পেলো কী?

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জীবনানন্দ দাশের কষ্টের কবিতা জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার নাম জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন জীবনানন্দ দাশের রোমান্টিক কবিতা pdf জীবনানন্দ দাশের কবিতা ক্যাপশন জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন

  সময়ের কাছে সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ’লে যেতে হয় কি কাজ করেছি আর কি কথা ভেবেছি। সেই সব একদিন হয়তো বা কোনো এক সমুদ্রের পারে আজকের প...